
মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫
প্রথম পাতা » প্রিয়দেশ | বিশেষ প্রতিবেদন | বিশেষ বিভাগ | শিরোনাম | সাবলিড » নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন প্রধান উপদেষ্টার সফরে প্রাপ্তি কী?
নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন প্রধান উপদেষ্টার সফরে প্রাপ্তি কী?
বিবিসি২৪নিউজ,কূটনৈতিক প্রতিবেদক ঢাকা: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সর্বশেষ লন্ডন সফর নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে৷ বিভিন্ন দেশে সফরগুলো থেকে এখন পর্যন্ত কী অর্জন হয়েছে।
যুক্তরাজ্য সফরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার সাক্ষাৎ না দেওয়ায় সমালোচনা আরও তীব্র হয়েছে৷ শুধু এই সফরটি নয়, এর আগে গত ১০ মাস পাঁচ দিনে ড. ইউনূস যে ১১টি দেশ সফর করেছেন সেগুলো থেকে বাংলাদেশে প্রাপ্তি কী? রাষ্ট্রের বিপুল টাকা খরচ হলেও এই সফরগুলো থেকে ড. ইউনূস নিজে লাভবান হয়েছেন বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের কারো কারো অভিমত৷ আবার কারো মতে, সফরগুলোর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন৷
সর্বশেষ গত ৯ জুন ৩৭ জনের বহর নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস লন্ডন যান৷ সফরটিকে দ্বিপক্ষীয় রূপ দেওয়ার চেষ্টা হলেও সব খরচ বহন করতে হয়েছে বাংলাদেশকেই৷ শুধু তাদের অবস্থানের জন্যে লন্ডন শহরের অন্যতম ব্যয়বহুল দ্য হোটেল ডরচেস্টারে চার রাতের জন্যে ৩৭টি রুম রিজার্ভ করা হয়৷
যেসব দেশ সফর করেছেন
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে এর তিনদিন পর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্যারিস থেকে দেশে ফিরেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন৷ ওই মাসে তিনি কোনো বিদেশ সফর করেননি৷ তার বিদেশ সফর শুরু হয় সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সফরের মধ্য দিয়ে৷ এরপর ওই বছরের নভেম্বরে আজারবাইজানে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৯) যোগ দিতে যান তিনি৷ এরপর ডিসেম্বরে মিশর যান ডি-৮ সম্মেলনে যোগ দিতে৷
এই বছর অর্থাৎ ২০২৫ সাল তার শুরু হয় সুইজারল্যান্ড সফর দিয়ে৷ জানুয়ারিতে তিনি ওই সফর করেন ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (উব্লিউইএফ) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে৷ এরপর এই বছর চীন, জাপান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড, কাতার, ভ্যাটিকান সিটি সফর করেন৷ সর্বশেষ গত ৯ জুন যুক্তরাজ্য সফরে যান ড. ইউনূস৷ এই সফরে ‘২০২৫ কিংস ফাউন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড’ এর অংশ হিসেবে ড. ইউনূসকে দ্য কিং চার্লস হারমোনি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেন রাজা তৃতীয় চার্লস৷ পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টাবিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন৷ কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের সঙ্গে বৈঠকের অনুরোধ করা হলেও তাতে তিনি সাড়া দেননি৷
লন্ডন সফরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
সরকার প্রধানের দ্বিপাক্ষিক সফর হলেও এতে সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, সচিবসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎপরতা দেখা না যাওয়া নিয়েও নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে৷ ড. ইউনূসকে লন্ডন বিমানবন্দরে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশের হাইকমিশনার৷
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, ”আগে আমরা সবাই মিলে ড. ইউনূসের প্রসংশা করতাম৷ এখন একমাত্র তার প্রেস সেক্রেটারি ছাড়া কেউই গুনগান করেন না৷ এমনকি তার উপদেষ্টা পরিষদের কেউও এ নিয়ে কোন কথা বলেন না৷ এ সফরে সরকারের অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, যা পুরো সফরকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে৷”
চার দিনের এই সফরে প্রধান উপদেষ্টার সাথে যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, হাউজ অব কমন্সের স্পিকার, যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যমন্ত্রী, অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ এবং কমনওয়েলথ মহাসচিব ছাড়াও যুক্তরাজ্য সরকার ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সাক্ষাত করেন৷ যদিও সরকারি সফর হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার সাক্ষাত হওয়ার কথা থাকলেও এ সফরে সেটি হয়নি৷
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় যুক্তরাজ্য সফরের পাঁচটি অর্জনের কথা উল্লেখ করেছেন৷ এগুলো হলো-
১. রাজা চার্লসের কাছ থেকে একটি মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার গ্রহণ ও ব্রিটিশ রাজার সাথে ৩০ মিনিটের একান্ত (ওয়ান টু ওয়ান) বৈঠক৷
২. দেশটির বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতার সাথে প্রধান উপদেষ্টার ‘ঐতিহাসিক’ সভা৷
৩. যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক শীর্ষ সহযোগীর ১৭ কোটি পাউন্ড মূল্যের সম্পদ জব্দ করেছে৷ এনসিএ কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি সংস্থাটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সম্পদ জব্দের ঘটনা৷
৪. বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (এসিসি) প্রধানসহ বাংলাদেশ ও ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ধারাবাহিক বৈঠক৷ সম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য আরও গভীর সহযোগিতার পথ তৈরি করতে এসব বৈঠক হয়েছে৷
৫. রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ব্যাপারে নতুন আশার সঞ্চার৷
লন্ডন সফরকে সফল দাবি গভর্নরের
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে লন্ডনের এই সফরে ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. আবদুল মোমেন৷ লন্ডন সফর থেকে বাংলাদেশের অর্জন কী? জানতে চাইলে গর্ভনর ড. আহসান এইচ মনসুর ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে৷ এসব বৈঠকে দেশের অর্থনীতি, দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম, সম্পদ পুনরুদ্ধার ও বৈদেশিক বিনিয়োগের বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা হয়৷ ১১ জুন আমরা যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) এবং আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সমন্বয় কেন্দ্রের (আইএসিসিসি) শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি৷ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইএসিসিসি’র প্রধান ড্যানিয়েল মারফি৷”
বাংলাদেশ সরকারের সম্পদ পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে আইএসিসিস‘র সহায়তা এবং ১১টি অগ্রাধিকারমূলক মামলায় গঠিত যৌথ তদন্ত দলের (জেআইটি) কারিগরি সহায়তার আশ্বাস দেওয়ার কথাও জানান গর্ভনর৷ তিনি বলেন, “দুর্নীতির টাকা ফেরত আনা একটা লম্বা প্রক্রিয়া৷ কাজটা আমরা শুরু করেছি৷ আইনগত বিষয় মোকাবিলা করে সমাধান পেতে সময় লাগবে৷ সবকিছু মিলিয়ে আমরা যে প্রত্যাশা নিয়ে গিয়েছিলাম সেটা সফল হয়েছে৷”
গর্ভনর ফিরে আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের যুক্তরাজ্যে থাকা সম্পত্তিতে ১৭কোটি পাউন্ড এবং বেক্সিমকো গ্রুপের শায়ান রহমান ও শারিয়ার রহমানের ৯০ কোটি পাউন্ডের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে৷ এই ২৬ কোটি পাউন্ড জব্দের সম্মিলিত উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবে অন্য দেশগুলোতেও অনুরূপ পদক্ষেপ নিতে উদ্বুদ্ধ করবে৷ সফর শেষে গভর্নর আশা প্রকাশ করেন, এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলো দেশের আর্থিক খাত, দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম এবং বৈদেশিক সম্পদ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় নতুন গতি সঞ্চার করবে৷
দুর্নীতির টাকা ফেরত আনা প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করে বাংলাদেশে অবস্থান করা আরশাদ মাহমুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ইউরোপ ও অ্যামেরিকার দেশগুলো তো আইন কানুন মেনে চলে৷ তারা কি কখনও কাউকে প্রশ্ন করেছে তুমি এত টাকা কোথা থেকে আনলে? আমাদের মতো দেশ থেকে এই টাকা পাচার হয়ে সেখানে যায়৷ কিন্তু ওই দেশগুলো থেকে কি কখনও পাচার করা টাকা কেউ ফেরত আনতে পেরেছে? আমি দীর্ঘকাল অ্যামেরিকায় বসবাস করে এমন কোন উদাহরণ দেখিনি৷ না হলে গভর্নর যা বলছেন, এগুলো শুধু বলার জন্য বলা৷ এসব কোন কাজে আসবে না৷”
প্রশ্ন উঠেছে অন্য সফরগুলো নিয়েও
সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি তার ফেরিফাইড ফেসবুকে প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরকে ‘দরিদ্রের টাকায় বিলাসবহুল বিশ্বভ্রমণ’ আখ্যায়িত করেছেন৷ অন্যদিকে সাংবাদিক আনিস আলমগীর বলেছেন, ‘‘ইউনূস এখন পর্যন্ত যত সব ভ্রমণে যাচ্ছেন, সবগুলোতে রাষ্ট্রের টাকায়ই যাচ্ছেন এবং তিনি ‘ভ্রমণবিলাসে’ আছেন৷ ব্রিটিশ চ্যারিটি পুরস্কার আনতে এত বড় বহর নিয়ে তার যাওয়ার কেন প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, আমরা জানি না৷ গত ১০ মাসে ড. ইউনূস এই সফরসহ ১১টি বিদেশ সফরে গেছেন, যার সবগুলো সরকারি অর্থে৷ এর মধ্যে একমাত্র চীন সফর ছিল দ্বিপাক্ষিক৷”
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “রাষ্ট্রের টাকায় এভাবে ভ্রমন বিলাস চলতে পারে না৷” তিনি প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের খরচসহ সামগ্রিক বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানান৷
সরকারের অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে: ফয়েজ আহমেদ
২৬ মার্চ চার দিনের সফরে চীন যান প্রধান উপদেষ্টা৷ সফরের পর চীন-বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্মেলনে অংশ নিয়ে চীনা বিনিয়োগকারীরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি, উন্নত বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্প, উৎপাদনশিল্প, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি খাতে বিনিয়োগে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন৷ গত ১ মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত চীন-বাংলাদেশ বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্মেলনে অংশ নেওয়া চীনা ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ উল্লেখ করে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ তাদের বিনিয়োগের জন্য শীর্ষ পছন্দ হতে পারে৷
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম শফিউল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “সবগুলো সফর নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক না৷ বিশেষ করে জাতিসংঘে গিয়ে তিনি বাইডেনসহ ৪০ জন বিশ্ব নেতার সঙ্গে সাইডলাইনে বৈঠক করেছেন৷ এতে দেশের ভাবমূর্তি উন্নত হয়েছে৷ তিনি জাতিসংঘ মহাসচিবকে বাংলাদেশে এনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে গেছেন৷ চীনের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন৷ এমনকি সর্বশেষ লন্ডন সফরে কিছু না পেলেও রাজা চার্লসের কাছ থেকে একটি মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার গ্রহণ দেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে৷ এর আগে কি বাংলাদেশের কেউ এমন পুরস্কার পেয়েছেন? ফলে সবকিছু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখলে হবে না৷”