
সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫
প্রথম পাতা » আর্ন্তজাতিক | ইউরোপ | শিরোনাম | সাবলিড » জার্মান নাগরিকত্ব পেতে তুর্কিদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি!
জার্মান নাগরিকত্ব পেতে তুর্কিদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি!
বিবিসি২৪নিউজ,অনলাইন ডেস্ক: ২০২৪ সালে জার্মান নাগরিকত্ব পাওয়া তুর্কিদের সংখ্যা তার আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়েছে৷ সামাজিক, রাজনৈতিক নানা কারণেই তুর্কিদের মধ্যে এই প্রবণতা বাড়ছে৷
তুর্কিদের কাছে জার্মানি ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে৷ পড়াশোনা, জীবন যাপন কিংবা চাকরির জন্য৷ পরিসংখ্যান অন্তত এমনটাই বলছে৷
জার্মান সরকারের অভিবাসন বিষয়ক পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালে ২২ হাজার ৫২৫ তুর্কি জার্মানির নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন৷ ২০২৩ সালের সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, ২০২৪ সালে তুর্কিদের মধ্যে জার্মান নাগরিকত্ব গ্রহণের হার ১১০ ভাগ বেড়েছে৷
সরকারের হিসেব অনুযায়ী, জার্মানির নাগরিকত্ব গ্রহণের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন তুর্কিরা৷ প্রথম স্থানে সিরীয়রা৷
আট বছর আগে জার্মানিতে এসেছিলেন তুরস্কের আলাস সুমার৷ মূলত পড়াশোনার উদ্দেশ্যে জার্মানিতে এসেছিলেন তিনি৷ আইনজীবী সুমার রাজধানী বার্লিনের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন৷ সেইসাথে পিএইচডি ডিগ্রির পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি৷
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘প্রতিটি অভিবাসীরই নাগরিকত্ব পাওয়ার ইচ্ছা থাকে৷ অবশ্য এটি বাস্তবধর্মী বিষয়৷ তা না হলে আপনি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে থাকবেন আর এটি এখানে (জার্মানিতে) মারাত্মক৷ রেসিডেন্স পার্মিট পাওয়া নির্যাতনমূলক (জটিলতা অর্থে) হয়ে ওঠে৷”
ইস্তাম্বুলের বোগাজিচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন বুরাক কেচেলি৷ ২০১৬ সালে চাকরির উদ্দেশ্যে জার্মানিতে আসেন তিনি৷ বর্তমানে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে বাস করেন কেচেলি৷
‘‘আমি অনেক দিন ধরেই জার্মানিতে আছি এবং জার্মান ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারি৷ আমি চেয়েছি, আমার রাজনৈতিক মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ পেতে৷ জার্মানির পাসপোর্ট এইক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ ভিসা ছাড়াই আমি বিশ্বের অনেক দেশ ভ্রমণ করতে পারি৷”
গ্লোবাল পাসপোর্ট ইনডেক্স ২০২৫-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের শক্তিশালী পাসপোর্টের তালিকায় পঞ্চম স্থানে রয়েছে জার্মানি৷ জার্মানির পাসপোর্টধারীরা বিশ্বের ১৩১টি দেশে ভিসামুক্ত চলাচল করতে পারেন৷ তুরস্কের পাসপোর্টে ৭৫টি দেশে এমন সুযোগ পাওয়া যায়৷
দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধা
গত বছরের জুন মাসে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের পর অভিবাসীদের মধ্যে জার্মানির নাগরিকত্ব নেওয়ার বিষয়ে অনেক বেশি আগ্রহ দেখা দিয়েছে৷ নতুন আইনে দ্বৈত নাগরিত্বের সুযোগ থাকায় অনেক অভিবাসীর মধ্যেই এই প্রবণতা বাড়ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
যেমন, আইনজীবি সুমার নিজের তুরস্কের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে চান না৷ ‘‘আমি ভোট দিতে পারার অধিকার ত্যাগ করতে চাই না৷ তাছাড়া, যেই দেশগুলোতে জার্মানির চেয়ে তুরস্কের সম্পর্ক ভালো ওই দেশগুলোতে তুরস্কের পাসপোর্টের সুবিধা রয়েছে৷”
বুরাক কেচেলিরও দ্বৈত নাগরিত্ব রয়েছে৷ জার্মানির এই সুযোগটিকে অত্যন্ত ইতিবাচক মনে করেন তিনি৷ এই সযোগ না থাকলেও জার্মান নাগরিত্ব পেতে চাইতেন বলে জানালেন কেচেলি৷
নাগরিত্বের বিষয়ে পূর্ববর্তী ওলাফ শলৎস সরকারের বেশ কিছু নীতিতে পরিবর্তন আনলেও, দ্বৈত নাগরিত্বের বিধান পরিবর্তন করেনি ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস সরকার৷ এর আগে জার্মান নাগরিত্ব পেতে চাওয়া অভিবাসীদের পূর্বের নাগরিকত্ব ত্যাগ করার বিধান ছিল৷ এ কারণে, অনেক অভিবাসী নিজ দেশের প্রতি আবেগ, নিজের পরিবার এবং ব্যবসায়ীক সম্পর্ক ধরে রাখার প্রয়োজনে জার্মান নাগরিত্ব পাওয়ার আবেদন করা থেকে বিরত থাকতেন৷
অবশ্য সুইজারল্যান্ড এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশের নাগরিকদের জন্য এমন বিধান ছিল না৷
রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থা
রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণেও দেশ ত্যাগ করছেন তুরস্কের অনেকে৷ সুমার জানালেন, ‘‘আমি শিক্ষকতা করতে চেয়েছি৷ কিন্তু তুরস্কে স্বাধীনভাবে এটি করতে পারবো বলে আমার মনে হয়নি৷ পরিস্থিতি যখন খারাপ হলো, আমি তুরস্ক ত্যাগ করলাম৷”
কেচেলিও অনেকটা একই কথা বললেন৷ জানালেন, তুরস্কে সুন্দর জীবন যাপনের নিশ্চয়তা পাচ্ছিলেন না তিনি৷ ‘‘আমি যদি জার্মানি না গিয়ে অন্য কোনো দেশে যেতাম, সেখানেও সম্ভবত নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতাম৷”
বেশ কয়েক বছর ধরেই তুরস্কের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনমন হচ্ছে৷ মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রায়ই সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার এবং বাক স্বাধীনতা লংঘনের বিষয়ে প্রতিদেবন প্রকাশ করছে৷ গত মার্চে ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমসামগুলোকে গ্রেপ্তার করে ক্ষমতাসীন রেচেপ তাইয়্যিপ এর্দোয়ান সরকার৷ ইস্তাম্বুলের মেয়রকে প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ানের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বলে বিবেচনা করা হয়৷এদিকে দেশটির অথনৈতিক পরিস্থিতিও ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে৷ উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৫ সালে এক ইউরোর সাথে তুরস্কের স্থানীয় মুদ্রা লিরার বিনিময় মুল্য দুই দশমিক ৩৷ বর্তমানে তা ৪৬ লিরায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে৷
‘তুরস্ক সবসময়ই নিজের ঘর’
জার্মানিতে দীর্ঘ সময় ধরে বসাবস এবং এখানকার সমাজে একীভূত হওয়ার পরও অনেক তুর্কি তুরস্কের সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িত বলে মনে করেন৷ তুরস্ককেই নিজের বাড়ি বলে মনে করেন৷
সুমার বললেন, ‘‘জার্মানি কখনোই আমার বাড়ি নয়৷ আমি নিজেকে জার্মান বলেও পরিচয় দিই না৷ আর যদি তা করিও, জার্মানরা আমাকে নিয়ে হাসে, অবশ্য ঠিকই আছে৷”
অনেকটা একই মতামত জানালেন কেচেলি৷ বললেন, ‘‘আমার প্রিয়জনদের সবাই তুরস্কে বাস করেন৷ আমি কখনোই এই বাঁধন হারাবো না৷ আমি তুরস্কে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকবো৷ আমি সব সময়ই তুরস্ককে আমার দেশ বলবো৷ আমি আসলে জার্মানিকে নিজের বাড়ি মনে করি না৷”
জার্মানদের মতো হয়ে উঠা
আট বছর ধরে বসবাসরত সুমার জানালেন, জার্মানিতে জীবনযাপন উপভোগ করেন তিনি৷ যদিও স্বীকার করলেন যে, নিজে জার্মান সমাজের অংশ হয়ে উঠেছেন, এমন অনুভূতি হয় না তার ৷ ‘‘আমার মনে হয় না যে, জার্মান নাগরিত্ব পাওয়ার পরপরই আপনি এইখানে মিশে যেতে পারবেন৷ আমার বেলায়ও তা হয়নি৷”
নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে সুমার বলেন, ‘‘আমি জার্মানদের তুলনায় তুর্কিদের সাথে চলাফেরায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি৷ বিষয়টি আমার কাছে পরিস্কার যে, আমি শুধুমাত্র কাগজে-কলমে একজন জার্মান৷”
এই সময়ে বৈষম্যের শিকার হযেছেন বলেও জানালেন সুমার৷ জার্মান নাগরিকত্ব পাওয়ার পর নিজের নামে বাসা খুঁজতে গিয়ে খুব একটা সাড়া পাচ্ছিলেন না বলে জানালেন তিনি৷ তবে ছদ্মনামে যোগাযোগ করার পর সাড়া মিলছিল বলে মনে হয়েছে তার৷
‘‘আপনার নাম জার্মানদের মতো না হলে, জার্মান পাসপোর্ট দিয়ে আসলে খুব বেশি কিছু হবে না,” বললেন তিনি৷