
মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫
প্রথম পাতা » আর্ন্তজাতিক | শিরোনাম | সাবলিড » উ. কোরিয়া- চায়না- রাশিয়া সম্পর্কের ঐতিহাসিক নতুন অধ্যায়
উ. কোরিয়া- চায়না- রাশিয়া সম্পর্কের ঐতিহাসিক নতুন অধ্যায়
বিবিসি২৪নিউজ,আন্তর্জাতিক ডেস্ক: রাশিয়ার চিফ অফ দ্য জেনারেল স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ ২৬ এপ্রিল কুরস্ক অঞ্চল মুক্ত করার ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার সেনাদের কৃতিত্ব দিয়েছেন। তিনি ভিডিও কলের মাধ্যমে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে ইউক্রেনীয় বাহিনীর দখলে থাকা কুরস্ক অঞ্চল পুনরুদ্ধারের বিষয়টি অবহিত করছিলেন। ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ ২০২৪ সালের অক্টোবরে সন্দেহ করেছিল যে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পিয়ংইয়ং তাদের সেনা পাঠিয়েছে। এই সন্দেহ প্রকাশের ছয় মাসের মধ্যে মস্কো আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর কোরিয়ার সেনা মোতায়েনের কথা স্বীকার করে। এরপর পিয়ংইয়ং কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের নামে একটি লিখিত বিবৃতি ঘোষণা করে। বিবৃতিতে তাদের সেনা প্রেরণের কথা প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে, সেনাদের ‘বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্ব’ এবং ‘উল্লেখযোগ্য অবদান’-এর জন্য প্রশংসা করা হয়। তাদের সেনা প্রেরণ এবং কুরস্ক পুনরুদ্ধারকে ‘উত্তর কোরিয়া-রাশিয়া সম্পর্কের জন্য একটি ঐতিহাসিক নতুন অধ্যায়, যা কৌশলগত জোট এবং ভ্রাতৃত্বের শীর্ষে পৌঁছেছে’ হিসাবে মূল্যায়ন করা হয়।
প্রেসিডেন্ট পুতিন ৯ মে অনুষ্ঠিত তবিজয় দিবসের সামরিক কুচকাওয়াজে উত্তর কোরিয়ার প্রতিনিধি দলের সঙ্গে করমর্দন করেন। কিম জং-উন দুজনের আট দশকের অটুট বন্ধুত্ব এবং সংহতি তুলে ধরে দাবি করেন যে, উত্তর কোরিয়ার এবং রাশিয়ার সেনারা তাদের ‘অভিন্ন শত্রু’কে নির্মূল করেছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ তাদের ‘সার্বভৌম অধিকার’ হিসাবে বৈধ ছিল। এই ধরনের মন্তব্য এবং তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে যে, তারা একটি শক্তিশালী জোট প্রদর্শন করছে যা ২০২৪ সালের জুনে উত্তর কোরিয়া-রাশিয়ার ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষরের পর পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।
একই সঙ্গে, মূল বিষয় হলো উভয় পক্ষ তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে কীভাবে ব্যাখ্যা করে তার মধ্যে একটি সূক্ষ পার্থক্য রয়েছে।
প্রথমত, যদিও রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর কোরিয়ার সেনা মোতায়েনের কথা স্বীকার করেছে, তবুও কিছু সূক্ষ পার্থক্য রয়েছে। উত্তর কোরিয়া এই সেনা মোতায়েনের ঘটনাকে বীরত্বপূর্ণ কাজ বলে বর্ণনা করেছে এবং দাবি করেছে যে, এই ধরনের সামরিক অবদান পারস্পরিক। যদিও রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার সেনাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় কোরিয় উপদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে তার ভূমিকার কথা উল্লেখ করেনি।
প্রকৃতপক্ষে, রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সহযোগিতাকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে, অন্যদিকে কিম দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে, কোরিয়ান উপদ্বীপে দক্ষিণ কোরিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের ‘যে কোনো আগ্রাসন’ ‘উত্তর কোরিয়া-রাশিয়া চুক্তির বিধান এবং চেতনা অনুসারে’ প্রতিহত করবে। মস্কোতে অনুষ্ঠিত বিজয় দিবসের সামরিক কুচকাওয়াজের সময়ও এই ধরনের পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে। কেউ কেউ অনুমান করেছিলেন যে, কিম কুচকাওয়াজে যোগ দেবেন, কিন্তু তিনি আসেননি। এর থেকে বোঝা যেতে পারে যে, বিভিন্ন দলের অংশগ্রহণে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানটি তাদের ঘনিষ্ঠ সময়গুলো প্রদর্শনের তার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।
দ্বিতীয়ত, উত্তর কোরিয়া এবং রাশিয়া তাদের সম্পর্ক শক্তিশালী করার সঙ্গে সঙ্গে অর্ন্তবর্তীকালীন মীমাংসা প্রক্রিয়ার সময় মতবিরোধ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যেখানে তারা একে অপরকে কী দিতে পারে তা নিয়েও আলোচনা করবে। সর্বোপরি, এটি বলা যেতে পারে যে কিম রাশিয়ার বিজয় দিবস উদযাপনে যোগ না দিয়ে উত্তর কোরিয়া ইতোমধ্যেই তার উদ্দেশ্য প্রকাশ করেছে। কুরস্ক পুনরুদ্ধারে উত্তর কোরিয়ার সেনাদের অবদান থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে এমন কোনো ইঙ্গিত নেই যে, উত্তর কোরিয়ার সেনারা পূর্ব ইউক্রেনে মোতায়েন করা হয়েছে, যেখানে রাশিয়া তার আক্রমণ তীব্রতর করছে। রাশিয়াকে অস্ত্র ও সেনা সরবরাহ করার ক্ষমতা ইতোমধ্যেই প্রদর্শন করার পর, উত্তর কোরিয়া হয়তো এই বার্তা দিতে চাইছে যে রাশিয়ার দাবির সঙ্গে আরও বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। রাশিয়া হয়তো ইতোমধ্যেই তার আর্টিলারি শেল, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং সেনা মোতায়েনের বিনিময়ে খাদ্য, জ্বালানি এবং প্রচলিত অস্ত্র পেয়েছে অথবা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
তৃতীয়ত, উত্তর কোরিয়া-চীন সম্পর্ক, সেইসঙ্গে দুই নেতার মধ্যে সম্পর্ককেও পরিবর্তনশীল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। উত্তর কোরিয়া-রাশিয়া সম্পর্ক জোরদার হওয়ার ফলে চীনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্কের ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যা উত্তর কোরিয়ার বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশেরও বেশি। উত্তর কোরিয়া কতদিন এই ধরনের ঝুঁকি সহ্য করতে পারবে তা অনিশ্চিত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়া চীনের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উত্তর কোরিয়া, চীন এবং রাশিয়া- এই তিনটি দেশই একনায়কতান্ত্রিক, এই সত্যটি সহযোগিতার জন্য উৎসাহ হিসেবে কাজ করে, একই সঙ্গে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জও তৈরি করে। একনায়কের নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা থাকে এবং এই আকাঙ্ক্ষা সাধারণত অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থার বাইরে এবং বৈদেশিক সম্পর্কের মধ্যেও পৌঁছায়। কিম জং-উনের নেতৃত্বে উত্তর কোরিয়া চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সমান অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে এবং মাঝে মাঝে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতাকে এগিয়ে নিতে চায়, তাই নেতাদের মধ্যে ফাটল দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, চীন ও রাশিয়া উত্তর কোরিয়াকে এখনো একটি জুনিয়র অংশীদারের ভূমিকায় রাখার চেষ্টা করছে।
কিছু দিক থেকে, উত্তর কোরিয়া এবং রাশিয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ইতোমধ্যেই মধুচন্দ্রিমা পর্ব পেরিয়ে সামঞ্জস্যের একটি পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার সেনাদের অংশগ্রহণের কথা দুই দেশই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে, এই ধরনের সমন্বয় ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে, উভয় দেশই উত্তর কোরিয়ার সেনা মোতায়েনের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করতে অনিচ্ছুক ছিল, মস্কো এটিকে ‘দুই দেশের বিষয়’ বলে অভিহিত করেছিল এবং পিয়ংইয়ং এটিকে ‘আন্তর্জাতিক আইনি নিয়ম অনুসারে একটি পদক্ষেপ’ হিসাবে বর্ণনা করেছিল। মোতায়েনের প্রাথমিক পর্যায়ে উত্তর কোরিয়ার সেনারা অনিবার্যভাবে যে উল্লেখযোগ্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, তা এই অনিচ্ছার পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে। উপরন্তু, প্রচারের উদ্দেশ্যে আরও উপযুক্ত মুহূর্তের জন্য তাদের ইচ্ছাকৃত অপেক্ষা প্রমাণ করে যে তারা নিজেরাই মোতায়েনের অযৌক্তিকতা স্বীকার করেছে। উত্তর কোরিয়া সম্ভবত তার বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্বের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ দাবি করবে, কিন্তু একটি জটিল পরিস্থিতি অল্পের জন্য এড়ানোর পর রাশিয়ার হিসাব এখন ভিন্ন মোড় নিতে পারে।