
মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » ইউরোপ | শিরোনাম | সাবলিড » তাপপ্রবাহে পুড়ছে ইউরোপ, রেড অ্যালার্ট জারি
তাপপ্রবাহে পুড়ছে ইউরোপ, রেড অ্যালার্ট জারি
বিবিসি২৪নিউজ,ইইউ প্রতিনিধি: ইউরোপজুড়ে চলছে নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, জার্মানি, পর্তুগাল, গ্রিসসহ বহু দেশে জারি করা হয়েছে সর্বোচ্চ মাত্রার তাপ সতর্কতা। ফ্রান্সসহ ইউরোপের দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ফ্রান্সজুড়ে বড় আকারে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার প্যারিসসহ ফ্রান্সের ১৬টি অঞ্চলে সর্বোচ্চ ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে। এছাড়া আরও ৬৮টি অঞ্চলে রয়েছে কম ঝুঁকির ‘অরেঞ্জ অ্যালার্ট’।
সোমবার ফ্রান্সের মূল ভূখণ্ডের ৯৬টির মধ্যে ৮৪টি অঞ্চলে ‘অরেঞ্জ অ্যালার্ট’ জারি ছিল। দেশটির জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী এটিকে ‘নজিরবিহীন পরিস্থিতি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং ক্রোয়েশিয়াসহ বলকান অঞ্চলের দেশগুলোর কিছু অংশেও তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এর বাইরে তুরস্কে দাবানল দেখা দিয়েছে।স্পেন এবং পর্তুগাল দুই দেশেই সপ্তাহান্তে জুন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ উষ্ণতম দিন হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।অনেক দেশেই জরুরি চিকিৎসা পরিষেবা প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং জনসাধারণকে যতটা সম্ভব ঘরের ভেতরে থাকার থাকতে বলা হয়েছে।
এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ইউরোপের বিভিন্ন অংশে তাপপ্রবাহ ছড়িয়ে পড়ায় ফ্রান্স জুড়ে প্রায় ২০০টি স্কুলের কোনটি বন্ধ কোনটি আংশিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে সপ্তাহের মাঝামাঝি তাপদাহ সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে।
মঙ্গলবার প্যারিসের স্থানীয় সময় দুপুর ১২ টা থেকে ফ্রান্সের রেড অ্যালার্ট কার্যকর হবে। তীব্র তাপপ্রবাহে রোববার দক্ষিণ কর্বিয়েরেস পর্বতমালায় বেশ কয়েকটি বনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটনাও ঘটেছে। ওইসব এলাকার লোকজনকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে একটি মোটরওয়ে।
সেখানকার কর্মকর্তারা ফরাসি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।
এরই মধ্যে ইতালির ২১টি শহরেও সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে রোম, মিলান, ভেনিস ও সার্ডিনিয়া দ্বীপ।
ইতালির জরুরি চিকিৎসা সেবা বিভাগের সহ-সভাপতি মারিও গুয়ারিনো সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, তাপপ্রবাহজনিত অসুস্থতা ও হিটস্ট্রোকের ঘটনা ১০ শতাংশ বেড়েছে।
সোমবার যুক্তরাজ্যের কিছু অংশে জুন মাসের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতমের কাছাকাছি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
ওইদিন যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে, ৩৩ দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিকে উইম্বলডনে তাপমাত্রা ছিল ৩২.৯ ডিগ্রি, যা টেনিস টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতম দিন।তাপ সতর্কতা রয়েছে স্পেনেও। যেখানে এবারের জুন হতে পারে দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতম মাস।
সেভিলে থাকা ২১ বছর বয়সী আনাবেল সানচেজ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, “আমি ঘুমাতে পারছি না। অনিদ্রায় ভুগছি। খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে প্রায়। কোন কাজে মন দিতে পারছি না।”
একই রকম পরিস্থিতি পর্তুগালেও। রাজধানী লিসবনসহ সাতটি জেলায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি রয়েছে।
জার্মানির আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, মঙ্গলবার ও বুধবার তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। এটি আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে জার্মানির রাইন নদীর পানি কমে গেছে। নদীর পানি কমে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ এই নৌরুটে পণ্যবাহী জাহাজে মালামাল পরিবহন কঠিন হয়ে পড়েছে। জাহাজগুলোকে কম পণ্য নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। যে কারণে পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে।
বলকান অঞ্চলের দেশগুলোও তীব্র গরমে ভুগছে। যদিও কিছু কিছু এলাকার তাপমাত্রা একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে।
ইউরোপের পাশেই তুরস্কে উদ্ধারকারীরা ৫০ হাজারেরও বেশি লোককে সরিয়ে নিয়েছে। বেশিরভাগই দেশটির পশ্চিমে অবস্থিত ইজমির থেকে লোকদের সরানো হয়েছে। দমকল কর্মীরা এখনো আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন।
ঘন্টায় ১২০ কিমি বা ৭৫ মাইল বেগে বাতাসে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার অন্তত ২০টি ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে।
ক্রোয়েশিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছে দাবানল। সেখানকার উপকূলীয় এলাকায় রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে। পাশের দেশ মন্টিনেগ্রোতেও তীব্র তাপমাত্রার সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
গ্রিসে কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির কাছাকাছি পৌঁছেছে। রাজধানী এথেন্সের আশেপাশের উপকূলীয় এলাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়েছে, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে হয়েছে, অনেকে নিরাপদ স্থানে যেতে বাধ্য হয়েছে।বুধবার ছিল সার্বিয়ায় ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণতম দিন। দেশটির আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, দেশের অনেক অংশে চরম খরা দেখা দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার রাজধানী সারায়েভোতে রেকর্ড ৩৮দশমিক ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। শনিবার স্লোভেনিয়ায় জুন মাসের ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
শুক্রবার উত্তর ম্যাসেডোনিয়ার রাজধানী স্কোপজেতে তাপমাত্রা ছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানাচ্ছে আবহাওয়া দপ্তর।
এই তাপপ্রবাহ শুধু স্বাস্থ্য নয়, পরিবেশেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এড্রিয়াটিক সাগরের উষ্ণ পানিতে বিষাক্ত ‘লায়নফিশ’ প্রজাতির মতো বিষাক্ত মাছের দেখা মিলছে। এর পাশাপাশি পাহাড়ি হিমবাহগুলো আরও দ্রুত গলতে শুরু করেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার টুর্ক বলেছেন, এই তাপপ্রবাহ দেখিয়ে দিচ্ছে যে আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রস্তুত হতে হবে। এবং জীবাশ্ম জ্বালানির মতো দূষণকারী শক্তির ব্যবহার কমাতে হবে।
তিনি বলেন, “তাপমাত্রা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, বন্যা, খরা ও দাবানল, এসব আমাদের জীবনের অধিকার, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত অধিকার হুমকির মুখে ফেলছে।”
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলের মতে, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে তাপপ্রবাহ ক্রমশ বাড়ছেই।
এতে বলা হয়েছে, পৃথিবী উষ্ণ হতে থাকলে তীব্র গরম আবহাওয়া আরও ঘন ঘন ঘটবে। ধীরে ধীরে এটি আরও তীব্র হবে।
যত উষ্ণ হচ্ছে, তত বেশি এবং তীব্র গরম দেখা দেবে বলে সতর্ক করেছে তারা।
যুক্তরাজ্যের রিডিং ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া বিজ্ঞানী রিচার্ড অ্যালান বলছেন, গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর পক্ষে অতিরিক্ত তাপ বের করে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, “তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাতাস আরও বেশি শুকনো হয়ে গেছে। ফলে মাটি শুকিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে মাঝারি মাত্রার গরমও এখন ভয়াবহ তাপপ্রবাহে পরিণত হচ্ছে।”